স্বপ্ন দেখেনা এমন মানুষ খুব কম।এমনকি ঐ সব মানুষরাও স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে যারা নিজেরাই জানে তাদের স্বপ্ন পূরণের কোন সম্ভাবনাই নেই। তারপরও মানুষ স্বপ্ন দেখে,নিজেকে নিয়ে,পরিবারকে নিয়ে,ভালবাসাকে নিয়ে।আবার এমনও অনেকে আছে যারা স্বপ্ন দেখে সমাজ নিয়ে,দেশ নিয়ে,জীবনে অর্থপূর্ণ কোন কিছু করার ইচ্ছে নিয়ে.......................।
আমার ক্ষেত্রে স্বপ্ন দেখাটা শুরু হয়েছিল কবে ঠিক মনে করতে না পারলেও ছোটবেলার সেই ‘আলাদিনের দৈত্যের’ স্বপ্নগুলো এখনও আবছা আবছাভাবে চোখে ভাসে।কার্টুন ছবিতে দেখতে দেখতে ‘দৈত্যের’ চেহারা মনের ভিতর এতটাই গেথে গিয়েছিল যে কখনো কখনো সে ঘুমের মধ্যেও চলে আসত।কি যে সব বায়না ধরতাম তার একফোঁটাও মনে নেই,হতে পারে সেটা চকলেট অথবা বউ পুতুলের জন্য রঙীন শাড়ি.................................এর বেশি আর কি।।তবে সেই সময়কার হাজারো বায়নার কথা মনে না থাকলেও একরাতে দৈত্যের কাছে কোনএক ইচ্ছাপূরণের দাবী জানাতে গিয়ে খাট থেকে যে পড়ে গিয়েছিলাম তা কিন্তু বেশ মনে আছে..!
সেসময় বিটিভিতে একটা কার্টুন খুব জনপ্রিয় ছিল ‘মিনা’।এখনও হয়তো দেখায়।বাংলায় ডাবিং করা কার্টুনটার প্রতি যতটা না আকর্ষণ ছিল তার বেশি আকর্ষণ ছিল কার্টুন শেষের গানটার প্রতি।লাইন গুলো খুব সম্ভব এমনই ছিলো...........“আমি বাবামায়ের শত আদরের মেয়ে/আমি বড় হই সকলের ভালবাসা নিয়ে/আমারও তো সাধ আছে,আছে অভিলাষা.........আমি পড়ালেখা শিখতে চাই”........গানটা গুনগুনাতে গুনগুনাতে কতরকমের স্বপ্নে বিভোর হতাম তার কোন ঠিকঠিকানা নেই।পড়ার টেবিলে থাকত খোলা বই,বইয়ের পাতায় কবি নজরুলের ‘সংকল্প’,মনের ভিতর বাবামায়ের আদর্শ মেয়ে হওয়ার বাসনা আর দুচোখ জুড়ে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন............কখনো পাইলট হয়ে মেঘের দেশে,কখনো ডুবুরি হয়ে মুক্তোর সন্ধানে,কখনো বা মাউন্টেইনার হয়ে হিমালয়ের চুড়ায়...................মধুর সেই ছেলেবেলা।।
রূপকথার বই খুব পড়া হত একটা সময়; তবে বই পড়া শুরু করার আগেই শেষের পাতায় চলে যেতাম।দেখতাম-“অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল”-এই লাইনটা আছে কিনা।।রাক্ষস,খোক্ষসের সাথে যত যুদ্ধই হোক না কেন গল্পের শেষে রাজপুত্রের জয় এবং রাজপুত্র-রাজকন্যার বিয়ে যেন অবধারিত ছিল।এতসব গল্পের মধ্যে একটা গল্প প্রায় সময় উড়ে এসে জুড়ে বসত মনের আঙ্গিনায়। .....................“রাজপুত্র অজানার উদ্দেশ্যে বের হয়ে যেতে যেতে.........যেতে এক দিঘীর সামনে এসে দাড়াতো আর হটাৎ করে দিঘীর পানি সরে গিয়ে মস্ত এক সিড়ি বের হয়,যে সিড়ি গিয়ে শেষ হয় দিঘীর অনেক গভীরে।যেখানে রাজপুত্র খুজে পায় দীঘলকেশী ঘুমন্ত রাজকন্যাকে”।ছোটবেলা থেকেই যে বাসায় বড় হয়েছি তার সামনে বড় একটা পুকুর ছিল।পুকুরটার দু’পাড়ে ছিল বড় বড় দুটো সিড়ি; আমি আর মিসবা আমরা দু’ভাইবোন সেই পুকুরে গোসল করতাম বিল্ডিং এর অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে। ছেলেরা সব যার যার বাসা থেকে তেলের কন্টেইনার নিয়ে এসে তাতে চেপে পুকুরে নামত আর সাতার শিখত। আমি হয়ত কখনো সিড়িতে দাড়িয়েই এক কোমর পানিতে নাক চিপে দুই/তিন ডুব দিয়ে উঠে আসতাম। তবে বেশিরভাগ সময় কাটতো পাড়ে বসে খেলার সাথীদের গোসল দেখতে দেখতে।...........পুকুরের নীলচে সবুজ পানির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কখনো মনে হত............“মনে হত যেন পানিগুলো সব ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে,মস্ত সিড়ির ধাপগুলো জীবন্ত হয়ে চলে যাচ্ছে গভীর থেকে গভীরে,আর আমি যেন সিড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছি কোন এক অচিনপুরে”............।স্বপ্ন ভাঙতো পুকুরের পানিতে নাকানিচুবানি খেয়ে।পাড়ে চুপচাপ বসে থাকা স্বপ্নালু এই আমাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে সিড়ির পাশে একগলা পানিতে ফেলে দেয়ার কাজটা মিসবার জন্য নিত্যনৈমত্তিক হয়ে দাড়িয়েছিল।কিন্তু কেন জানি এত পানি খাওয়ার পরও সাতার জিনিষটা শেখা হলনা।।তারপরও নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি পুকুরের স্বাদ তো পেয়েছি অন্তত।এসময়কার বাচ্চারা পুকুর তো দূরে থাক,খেলার জন্য একটুকরো সবুজের সন্ধানই পায়না। এছাড়া রূপকথা,টোনাটুনির গল্প,টুনি নাককাটা রাজা এবং সাতরানির গল্প,চাচা চৌধুরী আর সাবু এসব মজাদার বই কয়টা বাচ্চা এখনো পড়ে কে জানে।।
শৈশব যায়,কৈশোর যায় স্বপ্ন দেখা ফুরায় না।টিনএজের সেই উথালপাথাল স্বপ্নগুলো,এই ঘুণে ধরা সমাজটাকে একটা তুমুল আন্দোলনের মাধ্যমে বদলে ফেলার ইচ্ছাগুলো...............মনে হতো আমরা চাইলেই যেন স্বপ্নগুলো সব সত্যি হয়ে যাবে-“গরীব আর গরীব থাকবেনা,মধ্যবিত্তের সন্তানদের সাধ আর সাধ্যের মধ্যকার দ্বন্ধ নিয়ে আর ভাবতে হবেনা,পত্রিকার পাতা খুলতেই চোখে পড়বেনা যুদ্ধে আহত কোন শিশুর নির্বাক চাহনি”.........এখন জানি,বুঝি এইসব স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন হয়তো একপ্রকার অসম্ভবই তারপরও কেন জানি মনের গভীরে কোথাও এক কোণে এই অসম্ভবগুলোকেই লালন করতে বড় ইচ্ছা করে।
এই পরিণত বয়সে এসে স্বপ্ন দেখতে অনেক ভয় লাগে। না,স্বপ্ন দেখাটা ভুলে যাইনি কিন্তু স্বপ্ন দেখতে গেলে যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথের কঠিন বাধাগুলোও চোখে ভেসে উঠে। তারপরও,এতসব জটিল হিসাব নিকাশের পরও মানুষ স্বপ্ন দেখে,স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে,স্বপ্ন নিয়ে বাচঁতে ভালবাসে............পৃথিবীর প্রতিটা বাবামা স্বপ্ন দেখে তার ছেলেমেয়ে বড় হবে,নাম কুড়াবে............তরতাজা যুবকটা স্বপ্ন দেখে অনেক ভালো একটা চাকরীর,তার বন্ধুদের ট্রিট দিতে হবে না..! ............তরুণীরা সবাই এমনকি সবচেয়ে অসুন্দর,কালো মেয়েটাও স্বপ্ন দেখে একটা সাজানো সংসারের,যেখানে থাকবে তার জন্য অফুরন্ত ভালবাসা...............দূরদূরান্তে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুরা সবাই স্বপ্ন দেখে একদিন তারা আবার একসাথে হবে,একদিন তারা সূর্যটা ছোঁবে..............................
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ভুলে যাই সবকিছু,ভুলে যাই জীবনের যত মারপ্যাঁচ,ভুলে যাই আমি কারো মেয়ে,কারো বোন, কারো স্ত্রী,কারো মা............শুধুই ইচ্ছে করে শৈশব কৈশোরের সেই আমিত্বকে ফিরে পেতে,ইচ্ছে করে সমুদ্রের মাঝের কোন নির্জন দ্বীপে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকি তিন গোয়েন্দার জিনার মত,ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে গাই,...............“ছেড়া পালে লাগুক হাওয়া/ছুটে চলুক জীবন মাতোয়ারা/জীবনটা যেন এক স্রোতস্রিণী/বয়ে চলুক অবাধ নিরবধি/কি লাভ লেনাদেনা হিসাব কষে/পাওয়া না পাওয়ার অংক কষে/চুপিচুপি সময় যে পালায়/কেন বসে কিসের আশায়/জীবনের এই সব নীল আয়োজন/পৃথিবীর এই রঙ্গশালায়/উড়ে যাক সব দমকা হাওয়ায়/জীবন চলুক হাসি,গান,কথায়”........................
স্বপ্নের কি আর শেষ থাকে..!! স্বপ্ন নিয়েই তো মানুষের বেঁচে থাকা…….!!!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন